দীর্ঘকাল পরাজিত থাকতে থাকতে মানুষের বিজয়ের তৃষ্ণা মরে যায়। কৃষক যেমন
উবু হয়ে মাটির পোকার মতো কাজ করে যায়, পরাজিত জাতি ইতিহাসের জমিনে তেমনি
উবু হয়ে চলে। কিন্তু বাংলাদেশিরা তেমন না। কোনো পরাজয়েই বাংলাদেশিদের
বিজয়তৃষ্ণা মরে না। এই জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক, সামরিক ও রাষ্ট্রিক পরাজয়ের
ফাঁসে বারবার পড়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সব ছাপিয়ে এ জাতির মনে এমন
এক বিজয়তৃষ্ণা দিয়েছে, সে আর ছোট হতে রাজি না। তাই কথায় কথায় তার বিজয় চাই।
বিজয় চাই সরকারের, বিজয় চাই মিডিয়ার, বিজয় চাই তরুণের, বিজয় চাই ক্লাসের
প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর। বিজয় চাই বিজয়ের সুখানুভূতির নেশায়।
শিশুরা
যেমন করে জিততে চায়, সামান্য চেষ্টায় আমরা তেমন বিজয় চাই। শিশু যা চায়,
তক্ষুনি চায়। হয়তো পরে আর সে খেলনার দিকে ফিরেও তাকাবে না বা ভেঙে ফেলবে;
তাহলেও এখন তার তা চাই। কিন্তু তা অর্জনের জন্য কঠিন সংগ্রাম আমাদের ধাতে
নেই। বাধ্য না হলে এই জাতি কঠিন পথ নিতে পারে না। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের বহু
ক্ষেত্র থেকে একে একে বিজয় সরে গেছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন,
‘স্বাধীনতার অর্জনগুলি আমরা হারিয়ে ফেলছি।’ কিন্তু সেদিকে তাকানোর ফুরসত
আমাদের কই? আমাদের প্রতিদিন নতুন পোশাকের মতো, নতুন বিজয় চাই। তাই অন্য সব
ক্ষেত্রে দমে গিয়ে বিজয়তৃষ্ণার তীব্র চুমুক আমরা দিয়েছি ক্রিকেট খেলার
মাঠে। খেলার প্রতিটি বিজয়কে তাই তুলনা করা হয় জাতীয় বিজয়ের
সঙ্গে—মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের অসম্ভব ত্যাগ, সংগ্রাম,
দুই যুগের সাধনার সঙ্গে যার ধারণা আছে, সে এটা বলবে না।
প্রতিটি বিজয়কে বাঙালির বিজয় হিসেবে দেখানোর জাতগর্বী মানসিকতাকেও আমরা
স্বাভাবিক ধরে নিয়েছি। অথচ পুরুষ ক্রিকেটের জাতীয় দলের শালগাছ তামিম একজন
অবাঙালি, লিটন-সৌম্য অমুসলমান, কিশোরী ফুটবলারদের সাফল্যের নায়িকারাও বেশির
ভাগই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার, দক্ষিণ এশীয় প্রতিযোগিতায় স্বর্ণজয়ী মাবিয়া
ছিলেন বিত্তের দিক থেকে তলার ঘরের মেয়ে। তাই বাংলাদেশ
বাঙালি-অবাঙালি-মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সবার।
খেলার মাঠে তলা থেকে উঠে আসা তারকাদের জ্বলন্ত নমুনা হাজির থাকলেও চশমার
দুই কাচে আমরা দুই মানুষ দেখি। কেউ দেখি জাতি, কেউ দেখি সম্প্রদায়। এভাবে
বাংলাদেশি হিসেবে আমরা হেরে যাই
বাস্তব জীবনে যতই পরাজয় ঘনিয়ে আসে, বিজয়ের আফিমে ততই বুঁদ হতে ভালোবাসি
আমরা। অনেকে আছেন, যাঁরা বলেন, ভালোটা দেখুন মশাই, খারাপটা ঢেকে রাখুন।
‘থিংক পজিটিভ’ ধরনের স্লোগানে চাঁদের অপর পিঠের অন্ধকার আড়ালে পড়ে যায়।
আমাদের সড়কে মানুষ মারার মেশিন ঘোরে, দুহাত কাটা মানুষও নাকি ‘বন্দুকযুদ্ধ’
করতে গিয়ে মরে যায়। নড়তে-চড়তে অক্ষম অশীতিপর বৃদ্ধও হন নাশকতা মামলার
আসামি! কঠোর আইনে হাত-পা-মুখ-চোখ ও বিবেক বাঁধা পড়লেও আমাদের ভরসা রাখতে
বলা হয়। বিশ্বের মধ্যে বাসের অযোগ্য শহরে ভয়াবহ দূষণে মরতে মরতে আমরা যে
‘বিজয়’ উপভোগ করি, তা ওই অযোগ্যতার দূষণেরই বিজয়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার,
সুবিচার হারিয়ে আমরা উন্নয়নের তারাবাজি করতে আকাশে রকেট ওড়াই। দেশের দ্রুত
বর্ধনশীল ধইনচাগাছের মতো ধনীদের দেখে বুকের ছাতি ফুলাই আর শিশুর মুখে লবণ
দিয়ে মেরে ফেলে এক অভাবী মা হন ‘অপরাধী’। ইতিহাসের ট্রেন আমাদের ফেলে চলে
যায় অন্য কোনো রাজধানীতে, আমরা বলি এটাই আমাদের ‘সাফল্য’! এক লোক গাছে উঠতে
গিয়ে পড়ে গেল। অন্যরা যাতে লজ্জা দিতে না পারে, তাই ধুলা ঝেড়ে উঠতে উঠতে
সে বলে, ‘আমি অ্যামনেই নেমে থাকি।’
যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা পছন্দের জিনিসের মতো পছন্দের বাস্তবতাও বেছে
নিতে পারেন। দেশে না হলে বিদেশে তো তা আছে। সেখানে খালি বিজয় আর সুখ।
সাধারণের জন্য আয়-রোজগার, জীবন-জীবিকা ও নিরাপত্তাবোধের বিজয় যখন বিলানো
কঠিন, তখন খেলার বিজয়ই একমাত্র যা সর্বজনীন। ক্রিকেটে বিজয়, ফুটবলে বিজয়,
জি-বাংলায় গান গাওয়ার বিজয়সহ কত-কী? আর যখন হারি, তখন ব্যক্তি খেলোয়াড়কে
দোষ দিয়ে ভুলে যাই। বৈশ্বিক জরিপেও ঢাকাকে অবসাদের চাপে থাকা শহর বলা
হয়েছে। বিভিন্ন খাতেই জমা-খরচের টালিখাতায় খরচ বেশি, জমা কম। অবসাদের মানুষ
সাময়িক আনন্দে ক্ষণিকের জন্য মাততে ভালোবাসে। আমাদের হয়তো সেটাই হয়েছে।
জয়-পরাজয়ে ভারসাম্য আছে, তারা আমাদের মতো এত ‘বিজয়ী’ হয় না, হতে চায়ও
না। খেলার মাঠে জাতীয় পতাকার সাময়িক উড়ালকে তারা রাষ্ট্রের পতন ঢাকতে
ব্যবহার করে না। জীবনে অবহেলিত কিন্তু মৃত্যুর পর জাতীয় পতাকায় ঢাকা
মুক্তিযোদ্ধার মুখের মতো আমাদের পরাজিত মুখকে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে ফেলা
হয়। জাতীয়তাবাদ, পতাকা, স্লোগান মুখস্থ কথা হয়ে ওঠে। যে বলে সেও বিশ্বাস
করে না, যে শোনে তারও কোনো ভক্তি আছে বলে মনে হয় না। সত্য হলে তো দেশটা এমন
হতো না।
যখন আমরা বিশ্বের মধ্যে উচ্চব্যয়ের উন্নয়ন প্রকল্প চালাচ্ছি, তখন আমাদের
দেশে একটি চাকরির জন্য হাজারো যুবক রিলিফের লাইনের মতো করে দাঁড়াচ্ছে। যখন
মানুষ গুম হয়ে যায়, তখন গডফাদাররা অট্টহাসি করে। যখন দ্রুত ধনী হওয়ার
বৈশ্বিক রেকর্ড আমরা ভাঙছি, তখন প্রবাসী শ্রমিকের কর্মসংস্থান আগের বছরের
চেয়ে ২৭ শতাংশ কমে গেছে। পোশাকশ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি মাত্র আট হাজারই নাকি
অনেক আর ব্যাংক লোপাটের হাজারো কোটি টাকা নাকি ‘সামান্য’! পুলিশ যতই
অন্যায় করুক, সরকারি ছাত্রসংগঠন যতই হাতুড়ি চালাক, তারা ততক্ষণ ভালো,
যতক্ষণ তারা ‘আমার’ লোক।
Wednesday, September 19, 2018
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
💜
ReplyDelete💜
ReplyDeletebetmatik
ReplyDeletekralbet
betpark
tipobet
slot siteleri
kibris bahis siteleri
poker siteleri
bonus veren siteler
mobil ödeme bahis
GAXİ6
mardin
ReplyDeleteküçükçekmece
tokat
güngören
avcılar
3NNK5E