মোতালেব সাহেব পাড়ার একজন জ্ঞানী মানুষ। তিনি যেমন সাহিত্যবোদ্ধা, তেমনি
ক্রিকেটবোদ্ধাও বটে। সেই মোতালেব সাহেব রাতারাতি ক্রিকেট ফ্যান থেকে ফুটবল
ফ্যান হয়ে গেলেন! তাঁর এই হঠাৎ পরিবর্তনে তাঁকে যারা চেনে তারা সবাই বিশেষ
আশ্চর্যান্বিত হলো। দু-একজন জিজ্ঞেসও করে বসল:
: কারণটা কী মোতালেব ভাই? আপনি রাতারাতি ফুটবল ফ্যান হয়ে গেলেন! ছিলেন তো ক্রিকেট ফ্যান?
: নাকি বিশ্বকাপ ফুটবল আসছে বলে ভোল পাল্টে ফেলেছেন?
: নাকি ক্রিকেটাররা রাজনীতিতে নামতে যাচ্ছে দেখে...
: দেখো ভাই, আমি কিসের ফ্যান হব আর কিসের এসি হব সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার। এখানে কি তোমাদের নোংরা নাকটা না গলালেই নয়?
তো,
অবশেষে সবাই মোতালেব সাহেবকে ঘাঁটানো বাদ দিল। তবে একজন পিছে লেগেই রইল।
তিনি হচ্ছেন মোতালেব সাহেবের বাড়িওয়ালা, তিনি মোতালেব সাহেবের বিশেষ ভক্ত
এবং ফুটবলেরও ভক্ত। তিনি ফের একদিন চেপে ধরলেন:
: ভাই সাহেব ঝেড়ে কাশুন।
: কেন কাশতে হবে? কেন?
: ওই যে আপনি রাতারাতি ক্রিকেট থেকে ফুটবল ফ্যান হয়ে গেলেন। সত্যি কথাটা বলুন তো...
এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মোতালেব সাহেব। বললেন:
: দেখুন, রোজা-রমজানের দিন তো আর মিথ্যে কথা বলা যায় না। বিষয়টা হচ্ছে নলেজ আর উইজডমের ব্যাপার, বাংলায় বলা যায় জ্ঞান আর প্রজ্ঞা...
: আরেকটু খোলাসা করে যদি বলতেন।
মোতালেব সাহেব বললেন:
: এই যে আপনি...টমেটো কিনে বাড়ি ফিরছেন...এই টমেটো কিন্তু সবজি না, একটা ফল; আই মিন ফ্রুট এটা জানেন তো?
: জি জানতাম না, জানলাম।
:
আপনার এই জানাটা হচ্ছে নলেজ। কিন্তু ফ্রুট সালাদে টমেটো দেওয়া যায় না—এটা
হচ্ছে উইজডম। ক্লিয়ার? বাড়িওয়ালার কাছে বিষয়টা মোটেই ক্লিয়ার হয়নি। তারপরও
তিনি আমতা-আমতা করে বললেন:
: ইয়ে...মানে এর সাথে আপনার ক্রিকেট থেকে ফুটবল ফ্যান হওয়ার বিষয়টা কী?
:
সেটাই তো বলতে যাচ্ছি...এই মাস চারেক আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, শ্রীলঙ্কা
আর বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি সিরিজের একটা খেলা দেখতে গেলাম মিরপুর
স্টেডিয়ামে। বিকেলে খেলা সকালে টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি দুটো লাইন। একজনকে
জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, টিকিটের লাইন কি দুটোই? সেই লোক বলল, ‘না, আপনি ছোট
লাইনটায় দাঁড়ান।’ দাঁড়ালাম। যথারীতি টিকিটও কাটলাম। হঠাৎ কৌতূহল হলো। বড়
লাইনে দাঁড়ানো একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, বড় লাইনটা কিসের? লোকটা বলল,
‘হালিমের।’
: হালিমের! আশ্চর্য হলেন যেন বাড়িওয়ালাও, কিন্তু ওই যে ফ্রুট সালাদের কথা কী যেন বললেন...
:
উদাহরণ দিয়ে আপনাকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করলাম আরকি...ফ্রুট সালাদে যেমন টমেটো
দেওয়া যায় না সে রকম টি-টোয়েন্টি টিকিটের লাইনের পাশে হালিমের লাইনটাও যায়
না, ক্লিয়ার? এ দেশের মানুষ ক্রিকেটের মর্ম এখনো বুঝে উঠতে পারেনি।
বাড়িওয়ালা
যেটা বুঝলেন, হালিমের লাইনের কারণেই বোধ করি মোতালেব সাহেব রাগে-দুঃখে
ফুটবল ফ্যান হয়েছেন। তিনি আর তাঁকে ঘাঁটালেন না। টমেটো নিয়ে হাঁটা দিলেন
বাড়ির দিকে। গিন্নি সালাদ বানাবে, ফ্রুট সালাদ না অবশ্য।
কদিন পর এলাকার লোকজন জানতে পারল, মোতালেব সাহেব রাশিয়া যাচ্ছেন। ভিসাও নাকি হয়ে গেছে। তারা বলাবলি শুরু করল:
: যে লোক চা খেতে হলে রাস্তা পার হতে হবে বলে চা খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে সে এখন ফুটবল খেলা দেখতে রাশিয়া যাচ্ছে? ফুটবলের এত ভক্ত?
: ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!
: ঠিক ঠিক বিষয়টা জানতে হবে, ভালোমতো চেপে না ধরলে মোতালেব সাহেব ঝেড়ে কাশবেন না।
শেষ পর্যন্ত আবার সেই বাড়িওয়ালাই তাঁকে চেপে ধরলেন:
: মোতালেব সাহেব?
: বলেন।
: আপনি রাশিয়া যাচ্ছেন নাকি বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখতে?
: ঠিকই শুনেছেন। রাশিয়া যাচ্ছি, তবে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল দেখতে নয়...
: তাহলে কী করতে?
: বলতে পারেন ব্যবসা করতে।
: হঠাৎ আপনি ব্যবসা করতে যাচ্ছেন?
:
আমি যাচ্ছি রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে। ওখানে টেম্পারেচার মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি! কেন
জানেন না রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিন মাস ছয়েক আগে বলেছিলেন ওখানে গিয়ে
ব্যবসা করলে জমি ফ্রি, সে যে দেশের নাগরিকই হোক...আমি সেই প্রজেক্টে
যাচ্ছি।
: বলেন কী? তা কিসের ব্যবসা করবেন?
: কেন ফ্রিজের, ডিপ ফ্রিজের।
: কী বলছেন আপনি? মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি যে জায়গার তাপমাত্রা সেখানে আপনার ডিপ ফ্রিজ কিনবেটা কে?
: ওটাই তো ব্যবসা, বিষে বিষক্ষয়!
মোতালেব
সাহেবের বাড়িওয়ালা পরিষ্কার বুঝে গেলেন, মোতালেব সাহেব আসলে পাগল হয়ে
গেছেন। তিনি তিন দিনের মাথায় তাঁকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিলেন। নোটিশ পেয়ে
মোতালেব সাহেব অবাক!
: কী ব্যাপার ভাই সাহেব, হঠাৎ বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিলেন যে?
: আমার বাবা মৃত্যুশয্যায় একটা উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন।
: কী উপদেশ?
: সেটা হচ্ছে পুলিশ, পাগল আর প্যাকেজ নির্মাতাদের থেকে দূরে থাকতে।
: কী আশ্চর্য, আপনি কি আমাকে পাগল ভাবছেন?
: আপনি পুলিশ আর প্যাকেজ নির্মাতা যখন নন তখন...
: আপনার বাবা কী করতেন বলেন তো?
: প্যাকেজ নির্মাতা আর পাগল যখন ছিলেন না তখন...
: পুলিশ ছিলেন তাহলে? কিন্তু তিনি প্যাকেজ নির্মাতাদের থেকে দূরে থাকতে বললেন কেন?
:
আরে, কী আশ্চর্য, আগে ঈদে টিভি চ্যানেলের প্যাকেজ নির্মাতারা অ্যাডের
ফাঁকে ফাঁকে এক পর্বের নাটক দেখাত, এখন অ্যাডের ফাঁকে ফাঁকে দেখায় দশ
পর্বের নাটক...! আগে ছিল এক দিনের বর্ণাঢ্য অত্যাচার, এখন হয়েছে দশ দিনের
বর্ণাঢ্য অত্যাচার।
: কিন্তু উনি পুলিশ হয়ে...
: সেই জন্যই তো পুলিশ
হয়ে আসামিদের বেদম জিজ্ঞাসাবাদের নামে আসলে বেদম অত্যাচার করতেন...শেষ
বেলায় গিয়ে মানুষের কষ্টটা বুঝেছিলেন...তাই তার ওই থিওরি—পাগল, পুলিশ আর
প্যাকেজ নির্মাতা...
: ঠিকই বলেছেন আপনি, আমরা সবাই আসলে আসামি!
না, শেষ পর্যন্ত মোতালেব সাহেবের রাশিয়া যাওয়া হলো না। যেদিন ফ্লাইট,
সেদিন অজ্ঞান পার্টির পাল্লায় পড়ে সর্বস্ব খোয়ালেন তিনি। টানা তিন দিন
অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলেন একটা নাম না জানা ক্লিনিকে। কেউ দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে
এখানে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছে। জ্ঞান ফিরতেই দেখেন, একটা অচেনা নারীমুখ তাঁর
ওপর ঝুঁকে আছে।
: এখন কেমন বোধ করছেন?
: আমি কোথায়? রাশিয়ায় না ঢাকায়?
: আপনি ঢাকার একটি ক্লিনিকে। আমি আপনার নার্স। তবে আপনার জন্য একটা সুসংবাদ আর একটা দুঃসংবাদ আছে। কোনটা আগে শুনতে চান?
: দুঃসংবাদটাই আগে শুনি।
:
অজ্ঞান পার্টি আপনাকে যেভাবে অজ্ঞান করেছে তাতে করে আপনার ফুসফুস,
শ্বাসনালি—সব গেছে। বড়জোর মাসখানেক আমরা আপনাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে
রাখতে পারব!
: বলেন কী?
: আর সুসংবাদ হচ্ছে আপনার এলাকায় তো আপনি বেশ জনপ্রিয় লোক। তারা ঠিক করেছে আপনার মৃত্যুর পর আপনাকে একটা সংবর্ধনা দেবে।
: এটাই সুসংবাদ? মোতালেব সাহেব ক্ষীণ গলায় জানতে চান?
: না, ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একজন মন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে আসতে রাজি হয়েছেন!
Thursday, July 19, 2018
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment
thank you for your comments