বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। ১৮৯৪ খ্রি: ১২ই
সেপ্টেম্বর কাঁচড়াপাড়ার সমীপবর্তী ঘোষপাড়া-মুরাতিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে
জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতার নাম মৃনালিনী
দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল যশোর জেলার (বর্তমান চব্বিশ পরগনা জেলার)
অনর্ভুক্ত বনগ্রাম মহকুমায় অবস্থিত ইচ্ছামতী নদী তীরস্থ ব্যারাকপুর গ্রামে।
তাঁর পিতা কথকতা ও পৌরহিত্য করতেন। ফলে বাল্য ও কৈশোর কাটে দারিদ্র্যে,
অভাব ও অনটনের মধ্যে। বিভূতিভূষণ দুই ভাই এবং তিন বনের মধ্যে সবার বড়
ছিলেন।
তাঁর শিক্ষা শুরু হয় গৃহে পিতার নিকটে। শৈশব থেকেই তিনি
শিক্ষা জীবনে তাঁর মেধার পরিচয় দেন। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে
পাশ করেন ১৯১৪ খ্রি: বনগ্রামের হাইস্কুল থেকে। কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯১৬
খ্রি: আই. এ. ও ১৯১৮ খ্রি: ডিস্টিংশন নিয়ে বি.এ. পাশ করেন।
উচ্চতর পড়াশোনার জন্য এম.এ. ও ল'ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু সংসারের প্রবল
চাপে পড়া বন্ধ রেখে চাকুরী নিতে বাধ্য হন। কর্মজীবন শুরু করেন বিদ্যালয়ের
শিক্ষকতার চাকুরিতে। প্রথমে হুগলী জেলার জঙ্গীপাড়া গ্রামে স্কুলে। পরে
সোনারপুর হরিনাভি স্কুলে এবং পরে কলকাতার খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে।
হরিনাভি স্কুল থেকে চাকুরী নেবার আগে মধ্যবর্তী সময়ে তিনি কোশোরাম
পোদ্দারের গোরক্ষিনী সভার প্রচারের কাজ করেন। তারপর খেলাত্চন্দ্রের বাড়িতে
গৃহশিক্ষকতার সুত্রে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি ও পরে ভাগলপুর জমিদারীতে
নায়েব তহশীল্দারের কাজ করেন। ভাগলপুর শহরে বসবাস করতে থেকন। এই ভাগলপুর
প্রবাস কালেই তাঁর অমর উপন্যাস 'পথের পাঁচালী' রচিত হয়।
অবশ্য পরে শিক্ষকতার কাজে ফিরে যান এবং শেষ জীবন পর্যন্ত গোপাল নগর স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
কলেজে বি.এ. তৃতীয় বার্ষিক শ্রেনীতে পরার সময়। বিভুতিভুষণের সঙ্গে
বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীর সঙ্গে বিবাহ
হয়। কিন্তু বিয়ের অল্পকাল পরেই গৌরী দেবীর অকালমৃত্যু ঘটে। এই দূরঘটনার
বহুদিন পরে ৩র ডিসেম্বর ১৯৪০ খ্রি: ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ছয়গাঁও নিবাসী
ষড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা রমা দেবীকে তিনি বিবাহ করেন। এই দ্বিতীয়
বিবাহ বিভুতিভুষণের সাহিত্য জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
বাংলার পল্লীর অপরূপ সৌন্দর্য বিভুতিভুষনকে শৈশব থেকে মুগ্ধ করত। ফলে অতি
অকিঞ্চিত্কর লতা-গুল্ম, ফুল-পাতা, পাখি - প্রকৃতির বুকের নিভৃতে লালিত
প্রতিটি জীবনকে অতি নিবিড় ভাবে দেখার ও জানার সুযোগ পান। পরবর্তী কালে এই
প্রকৃতি পথের বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞতা নানাভাবে তাঁর রচনাকে প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ
করেছে।
প্রথম প্রকাশিত গল্প 'উপেক্ষিত', ১৩২৮ বঙ্গাব্দে প্রবাসী
পত্রিকায় মাঘ সংখ্যায় ছাপা হয়। প্রথম উপন্যাস 'পথের পাঁচালী'। প্রকাশিত হয়
১৩৩৬ বঙ্গাব্দে। প্রথম উপন্যাসই তাঁকে কথাসাহিত্যের প্রতিষ্ঠা এনে দেয়।
এরপর সাহিত্যচর্চার দীর্ঘ একুশ বছরের পরিসরে তিনি বহু উপন্যাস, ছোটগল্প,
ভ্রমনকাহিনী এবং শিশু-সাহিত্য রচনা করেন।
বাংলার পল্লীপ্রকৃতির
সঙ্গে গ্রাম্য-জীবনের দুঃখ, দারিদ্র, স্বপ্ন, আশা, প্রেম, ভালবাসা তাঁর
রচনায় অপরিসীম দরদের সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। কেবল পল্লীপ্রক্রিতিই নয়, তাঁর
রচনায় অরণ্য ধরা পড়েছে তার সমস্ত রহস্যময়তা, প্রানোচ্ছল সজীবতা ও বৈচিত্র্য
নিয়ে।
এক ভাবুক কবির দৃষ্টিতে দেখা অরণ্য প্রকৃতির এক অপরিচিত লীলায়িত রূপ বিধৃত হয়েছে তাঁর বিখ্যাত 'আরণ্যক' উপন্যাসে।
দীর্ঘ একুশ বছরে সাহিত্যজীবনে গল্প, উপন্যাস, দিনলিপি, শিশুসাহিত্য মিলিয়ে
প্রায় অর্ধশতক গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে নিঃসন্দেহে 'পথের পাঁচালী' ও
'অপরাজিত'ই সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি।
বিভুতিভূষণের রচিত
উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ইচ্ছামতী, দেবযান, আদর্শ
হিন্দুহোটেল, বিপিনের সংসার, মেঘমল্লার, মৌরীফুল, যাত্রাবদল, দৃষ্টিপ্রদীপ
প্রভৃতি।
অনেক ক্ষেত্রে রোমাঞ্চক স্থানে ভ্রমণের মনোজ্ঞ কাহিনী
তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর 'বনে পাহাড়ে' ও 'হে অরণ্য কথা কও' নামক
গ্রন্থদ্বয়ে এবং তাঁর দিনলিপি জাতীয় গ্রন্থাবলীতে। কিশোরদের জন্য লিখেছেন
মিসমিদের কবচ, মরণের ডংকা বাজে, হীরা মানিক জ্বলে, চাঁদের পাহাড় প্রভৃতি।
বিভুতিভূষণের 'পথের পাঁচালী' ইংরাজী ও ফরাসী ভাষায় অনুদিত হয়েছে। মৃতুর
পরে ইচ্ছামতী উপন্যাসের জন্য তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভুষিত করা হয়।
জীবনের শেষ দশ বত্সর বিভূতিভূষণ তাঁর অতি প্রিয় পিতৃভূমি ব্যারাকপুরে বাস
করেছিলেন। অবশ্য একটানা নয়। মাঝে মধ্যেই তিনি ঘাটশিলায় গিয়ে থেকেছেন। এই
সময়ে তিনি অজস্র শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের সাহিত্য সৃষ্টি করেন। অনেকগুলি কালোচিত
উপন্যাস ও বহু সার্থক রসোত্তীর্ণ ছোট গল্প এই সময়ে রচিত হয়। জীবনের প্রায়
শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি সাহিত্য-সাধনায় ব্রতী ছিলেন।
১৯৫০ খ্রি: ১লা নভেম্বর, ঘাটশিলায় স্বগৃহে এই কালজয়ী ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ ৫৬ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন
Friday, June 29, 2018
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment
thank you for your comments