এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাঈদা রহিম বলেন, প্রস্রাবের
রং, চোখ ও ত্বক হলদে দেখালে জন্ডিস হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। অনেক কারণেই
জন্ডিস হতে পারে। তাই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে জন্ডিসের কারণ, মাত্রা,
জটিলতা ইত্যাদি জেনে নেওয়া উচিত। আর জন্ডিসের রোগীরা তাদের খাওয়া-দাওয়ার
ব্যাপারে খুবই বিভ্রান্তিতে থাকে। কী খেতে হবে আর কী খাওয়া যাবে না, এই
নিয়ে পরামর্শের যেন শেষ থাকে না। কারণ, জন্ডিস রোগীর পথ্যের ব্যাপারে
প্রচলিত বিশ্বাস অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞানের সঙ্গে খাপ খায়
না।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
সব সময় বিশুদ্ধ খাদ্য ও পানি খেতে হবে। শরীরে রক্ত নেওয়ার
দরকার হলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং করে নিতে হবে। ডিসপোজিবল সিরিঞ্জ
ব্যবহার করাটাও খুবই জরুরি। বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি-এর টিকা প্রত্যেকেরই
নেওয়া উচিত। যাঁরা সেলুনে শেভ করেন, তাঁদের খেয়াল রাখতে হবে যেন আগে
ব্যবহার করা ব্লেড বা ক্ষুর পুনরায় ব্যবহার করা না হয়। জন্ডিস হলে টিকা
নিয়ে কোনো লাভ হয় না। তাই সুস্থ থাকতে আগেই টিকা নিতে হবে। হেপাটাইটিস
বি-এর ক্ষেত্রে প্রথম মাসে একটি, দ্বিতীয় মাসে একটি বা ছয় মাসের মধ্যে একটি
ডোজ দেওয়া হয়। হেপাটাইটিস এ-এর ক্ষেত্রে একটি ডোজই যথেষ্ট। আর দুই
ক্ষেত্রেই পাঁচ বছর পর পর বুস্টার টিকা দেওয়া হয়।
চিকিৎসা
যেহেতু জন্ডিস কোনো রোগ নয়, তাই এর কোনো ওষুধ নেই। ৭ থেকে
২৮ দিনের মধ্যে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে গেলে জন্ডিস
এমনিতেই সেরে যায়। এই সময়ে পর্যাপ্ত বিশ্রামই চিকিৎসা। এ সময় ব্যথার ওষুধ
যেমন: প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, ঘুমের ওষুধসহ অন্য কোনো অপ্রয়োজনীয় ও
কবিরাজি ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। এককথায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো
ওষুধই বাস্তবে সেবন করা ঠিক না। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার ঝুঁকিটাই বেশি থাকে।
সাবধানতা
রোগীকে বাইরের খাবার সব সময় পরিহার করতে হবে। বিশেষ করে
খুব সাবধান থাকতে হবে পানির ক্ষেত্রে। জন্ডিস থাক বা না থাক, না ফুটিয়ে
পানি পান করা যাবে না। বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে ফুচকা, চটপটি, বোরহানি আর
সালাদের ব্যাপারে। কারণ, হেপাটাইটিস এ বা ই-এর মতো পানিবাহিত ভাইরাসগুলো
এসবের মাধ্যমেই ছড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের খুব সাবধান থাকা
উচিত। এ সময় মায়েরা প্রায়ই বাইরের খাবার খেয়ে থাকেন। আর গর্ভাবস্থায় শেষ
তিন মাসে যদি হেপাটাইটিস ই হয়, তবে তা থেকে মা ও গর্ভের শিশুর মৃত্যুর
আশঙ্কা শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি।
খাবার কেমন হবে?
খাবারের ব্যাপারে তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে ভাইরাল
হেপাটাইটিসে যকৃতের কার্যকারিতা কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়। তাই যকৃৎ ও
পিত্তথলির ওপর অতিরিক্ত কাজের চাপ সৃষ্টি না হয় এমন কিছু খাবার এড়িয়ে চলাই
উচিত। যেমন চর্বিজাতীয় খাবার (ঘি, মাখন, যেকোনো ভাজা খাবার বা ফাস্টফুড,
গরু-খাসির মাংস ইত্যাদি)। জন্ডিসের রোগীদের ক্যালরির উৎস হিসেবে তাই সহজে
হজমযোগ্য সরল শর্করা, যেমন: শরবত, ভাত, জাউভাত, সুজি, রুটি ইত্যাদি বেশি
খাওয়া উচিত।
বিশ্রাম কেমন হবে?
পূর্ণ বিশ্রাম মানে এই সময়ে ভারী কোনো কাজ বা পরিশ্রমের
কোনো কাজ না করা। কারণ, ভাইরাল হেপাটাইটিস লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে। ফলে
পূর্ণ বিশ্রাম না নিলে বা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের ফলে জন্ডিসের মাত্রা
বেড়ে গিয়ে জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
কিছু ভ্রান্ত ধারণা
অনেকে মনে করে, জন্ডিস হলে বেশি বেশি পানি পান করতে হবে।
খেতে হবে বেশি করে আখের রস, ডাবের পানি, গ্লুকোজের শরবত ইত্যাদি। আসলে
ব্যাপারটি এ রকম নয়। জন্ডিস রোগীকে সাধারণ মানুষের মতোই পর্যাপ্ত পরিমাণে
পানি খেতে হবে। সমস্যা হতে পারে স্বাভাবিকের চেয়ে কম পানি পান করলে। বেশি
বেশি পানি খেলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয় বলে তা কিছুটা হালকা হয়ে এলেও রক্তে
বিলিরুবিনের পরিমাণ এতে বিন্দুমাত্র কমে না। বরং ঘন ঘন প্রস্রাব করার জন্য
রোগীকে বারবার টয়লেটে যেতে হলে রোগীর বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটে।
আখের রস আমাদের দেশে জন্ডিসের একটি বহুল প্রচলিত ওষুধ।
রাস্তার পাশের যে দূষিত পানিতে আখ ভিজিয়ে রাখা হয় সেই পানি মিশ্রিত আখের রস
খাওয়া থেকে হেপাটাইটিস এ বা ই ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়াতে পারে।
আরেকটি প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে জন্ডিসের রোগীকে হলুদ দিয়ে
রান্না করা তরকারি খেতে দিলে নাকি জন্ডিস বাড়তে পারে। কথা হলো, রক্তে
বিলিরুবিন নামক একটি হলুদ পিগমেন্টের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণেই জন্ডিস
দেখা দেয়। এর সঙ্গে খাবারের হলুদের কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই।
জন্ডিসে আক্রান্ত মায়ের দুগ্ধদানে মানা নেই
জন্ডিস রোগে আক্রান্ত মা নিশ্চিন্তে তাঁর সন্তানকে দুধপান
করাতে পারেন। তবে মায়ের যদি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসজনিত জন্ডিস হয়ে থাকে তবে
শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা এবং
ইমিউনোগ্লোবুলিন ইনজেকশন দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ, মায়ের দুধের মাধ্যমে
না ছড়ালেও, মায়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে শিশুর হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত
হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
নবজাতকের জন্ডিস
সব ঠিকঠাক থাকলেও জন্মের পর শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ নবজাতকের
জন্ডিস হতে পারে। জন্ডিস আক্রান্ত শিশুর প্রায় ৫০ শতাংশের বেলায় একে বলে
স্বাভাবিক জন্ডিস। শিশুর যকৃৎ পুরোপুরি কর্মক্ষম হয়ে উঠতে একটু দেরি হলে
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে এই জন্ডিস হয়। এ সময়ে কোনো অবস্থায়ই
নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত রাখা যাবে না। স্বাভাবিক জন্ডিস সাত
দিনের মধ্যেই সেরে ওঠার কথা। তবে জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই জন্ডিস দেখা
দিলে, সাত বা দশ দিনের পরও না সারলে, শিশু খাওয়া বন্ধ করে দিলে বা কমিয়ে
দিলে, জ্বর বা সংক্রমণের লক্ষণ থাকলে, বিলিরুবিনের মাত্রা দ্রুত বাড়তে
থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
0 comments:
Post a Comment
thank you for your comments